প্রোটিনের গুণগত মান নির্ণয়ের বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। এগুলো প্রোটিনের কার্যক্ষমতা, পাচন এবং শরীরে প্রোটিনের ব্যবহার নির্ণয় করে। প্রধান কিছু পদ্ধতি হলো:
১. প্রোটিনের কার্যক্ষমতার অনুপাত (Protein Efficiency Ratio, PER):
PER হলো সেই অনুপাত যা প্রাণীর ওজন বৃদ্ধির পরিমাণ এবং প্রোটিন গ্রহণের পরিমাণের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে।
প্রোটিনের কার্যক্ষমতার অনুপাত (PER) নির্ণয়ের পদ্ধতি:
PER নির্ণয়ের জন্য প্রয়োজন:
- প্রাণীর ওজন বৃদ্ধি (গ্রাম)।
- প্রোটিন গ্রহণের পরিমাণ (গ্রাম)।
PER এর গণনার সমীকরণ:
PER এর হিসাব করার জন্য নিম্নলিখিত সূত্র ব্যবহৃত হয়:উদাহরণ:
ধরা যাক একটি পরীক্ষায় প্রাণীদের 30 দিন ধরে নির্দিষ্ট প্রোটিন ডায়েটে রাখা হয়েছে। পরীক্ষার শেষে দেখা গেল যে প্রাণীগুলির মোট ওজন বৃদ্ধি পেয়েছে 60 গ্রাম এবং তারা মোট 20 গ্রাম প্রোটিন গ্রহণ করেছে।
সমাধান:
প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী:
- প্রাণীদের মোট ওজন বৃদ্ধি পেয়েছে: 60 গ্রাম
- তারা মোট প্রোটিন গ্রহণ করেছে: 20 গ্রাম
এখন এই তথ্যগুলিকে সূত্রে বসিয়ে হিসাব করলে পাবেন:
অর্থাৎ, এই পরীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী প্রোটিনের কার্যক্ষমতার অনুপাত (PER) হল ৩।
এটি নির্দেশ করে যে প্রতি 1 গ্রাম প্রোটিন গ্রহণের জন্য 3 গ্রাম ওজন বৃদ্ধি পেয়েছে। উচ্চ PER মান নির্দেশ করে যে প্রোটিনটি কার্যক্ষম এবং শরীরে ভালোভাবে ব্যবহৃত হয়।
২. পাচনাঙ্ক পদ্ধতি (Digestibility Method):
এই পদ্ধতিতে প্রোটিনের হজম এবং শোষণের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়।
পাচনাঙ্ক পদ্ধতির মূল ধাপগুলো:
প্রোটিন গ্রহণ: প্রাণী বা মানুষের খাদ্য তালিকায় নির্দিষ্ট পরিমাণ প্রোটিন অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
নাইট্রোজেন নির্ধারণ: প্রোটিনের নাইট্রোজেন বিষয়বস্তু নির্ধারণ করতে হয়, কারণ প্রোটিনে নাইট্রোজেন প্রধান উপাদান।
মলদ্বার নাইট্রোজেন পরিমাপ: খাদ্য গ্রহণের পর মলের মধ্যে অবশিষ্ট নাইট্রোজেন পরিমাপ করা হয়।
পাচনাঙ্ক নির্ণয়ের সমীকরণ:
পাচনাঙ্ক (Digestibility) নির্ণয়ের সাধারণ সমীকরণটি নিম্নরূপ:
উদাহরণ:
ধরা যাক, একজন ব্যক্তি 100 গ্রাম প্রোটিন গ্রহণ করেছে, যার মধ্যে নাইট্রোজেনের পরিমাণ 16 গ্রাম। মলে অবশিষ্ট নাইট্রোজেন পরিমাপ করা হয়েছে 4 গ্রাম।
সমাধান:
প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, গ্রহণকৃত নাইট্রোজেন = ১৬ গ্রাম এবং মলে অবশিষ্ট নাইট্রোজেন = ৪ গ্রাম।
তাহলে:
অর্থাৎ, এই ক্ষেত্রে প্রোটিনের পাচনাঙ্ক হল ৭৫%।
৩. জৈবমূল্য (Biological Value, BV):
BV হলো সেই অনুপাত যা শরীরে প্রোটিনের পুনঃব্যবহারযোগ্যতা এবং নাইট্রোজেনের ধারণ নির্ধারণ করে।
জৈবমূল্য (BV) নির্ণয়ের পদ্ধতি:
BV নির্ণয়ের জন্য নিম্নলিখিত উপাদানগুলো প্রয়োজন:
- গ্রহণকৃত প্রোটিন থেকে নাইট্রোজেনের পরিমাণ।
- শরীরে ধরে রাখা নাইট্রোজেনের পরিমাণ।
BV এর গণনার সমীকরণ:
BV নির্ণয়ের জন্য নিম্নলিখিত সমীকরণটি ব্যবহার করা হয়:
উদাহরণ:
ধরা যাক, একজন ব্যক্তি ১০০ গ্রাম প্রোটিন গ্রহণ করেছে, যার মধ্যে নাইট্রোজেনের পরিমাণ ১৬ গ্রাম। মলে অবশিষ্ট নাইট্রোজেন পরিমাপ করা হয়েছে ৪ গ্রাম এবং প্রস্রাবে নাইট্রোজেনের পরিমাণ ২ গ্রাম।
সমাধান:
প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী,
প্রথমে শোষিত নাইট্রোজেন নির্ণয় করি:
তারপর, শোষিত নাইট্রোজেন থেকে শরীরের বর্জ্য নাইট্রোজেন (প্রস্রাবের নাইট্রোজেন) বাদ দিই:
তাহলে,
অর্থাৎ, এই ক্ষেত্রে প্রোটিনের বায়োলজিকাল ভ্যালু (BV) হল ৮৩.৩%।
এটি নির্দেশ করে যে গ্রহণকৃত নাইট্রোজেনের ৮৩.৩% শরীরে ধরে রাখা হয়েছে, যা প্রোটিনের উচ্চ গুণগত মান নির্দেশ করে।
৪. নিট প্রোটিনের সদ্ব্যবহার (Net Protein Utilization, NPU):
NPU হলো শরীরে প্রোটিনের কার্যকরীতা এবং ব্যবহারযোগ্যতার পরিমাপ।
NPU নির্ণয়ের জন্য নিম্নলিখিত উপাদানগুলো প্রয়োজন:
- গ্রহণকৃত প্রোটিন থেকে নাইট্রোজেনের পরিমাণ।
- শরীরে ধারণকৃত নাইট্রোজেনের পরিমাণ।
- প্রোটিনের হজমযোগ্যতা।
NPU এর গণনার সমীকরণ:
NPU নির্ণয়ের সমীকরণটি হলো:
উদাহরণ:
ধরা যাক, একজন ব্যক্তি ১০০ গ্রাম প্রোটিন গ্রহণ করেছে, যার মধ্যে নাইট্রোজেনের পরিমাণ ১৬ গ্রাম। মলে অবশিষ্ট নাইট্রোজেন পরিমাপ করা হয়েছে ৪ গ্রাম এবং প্রস্রাবে নাইট্রোজেনের পরিমাণ ২ গ্রাম।
সমাধান:
প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী:
- একজন ব্যক্তি ১০০ গ্রাম প্রোটিন গ্রহণ করেছে, যার মধ্যে নাইট্রোজেনের পরিমাণ ১৬ গ্রাম।
- মলে অবশিষ্ট নাইট্রোজেন পরিমাপ করা হয়েছে ৪ গ্রাম।
- প্রস্রাবে নাইট্রোজেনের পরিমাণ ২ গ্রাম।
প্রথমে, দেহে সংরক্ষিত নাইট্রোজেন নির্ণয় করা হবে:
এখন, NPU নির্ণয় করা হবে:
অর্থাৎ, এই ক্ষেত্রে প্রোটিনের নেট প্রোটিন ইউটিলাইজেশন (NPU) হল ৬২.৫%।
এটি নির্দেশ করে যে গ্রহণকৃত নাইট্রোজেনের ৬২.৫% শরীরে ধারণ হয়েছে এবং কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হয়েছে।
৫. নিট প্রোটিনের অনুপাত (NPR) নির্ণয়ের পদ্ধতি:
সাধারণত দুটি উপাদান নিয়ে NPR নির্ণয় করা হয়:
- প্রাণীর প্রোটিন গ্রহণের ফলে ওজন বৃদ্ধি।
- প্রোটিন বিহীন খাদ্য গ্রহণের ফলে ওজন পরিবর্তন।
NPR এর গণনার জন্য নিম্নলিখিত সমীকরণ ব্যবহৃত হয়:
উদাহরণ:
ধরা যাক, একটি পরীক্ষায় দুটি গ্রুপের ইঁদুর ব্যবহার করা হয়েছে:
- পরীক্ষিত প্রোটিন গ্রুপ: এই গ্রুপ প্রোটিন-সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ করেছে।
- প্রোটিনবিহীন গ্রুপ: এই গ্রুপ প্রোটিনবিহীন (নাইট্রোজেন-মুক্ত) খাদ্য গ্রহণ করেছে।
সমাধান:
পরীক্ষার শেষে:
- পরীক্ষিত প্রোটিন গ্রুপের মোট ওজন বৃদ্ধি হয়েছে ২৫ গ্রাম।
- প্রোটিনবিহীন গ্রুপের মোট ওজন বৃদ্ধি হয়েছে ৫ গ্রাম।
তাহলে, NPR নির্ণয়ের সমীকরণটি হবে:
অর্থাৎ, এই পরীক্ষায় প্রোটিনের নেট প্রোটিন রেশিও (NPR) হল ৫।
এটি দেখায় যে নির্দিষ্ট প্রোটিনের কার্যক্ষমতা এবং শরীরে তার ব্যবহারযোগ্যতা ভালো। উচ্চ NPR মান নির্দেশ করে যে প্রোটিনটি কার্যক্ষম এবং শরীরে ভালোভাবে ব্যবহৃত হয়।
৬. রাসায়নিক সাফল্যাঙ্ক (Chemical Score):
রাসায়নিক সাফল্যাঙ্ক (Chemical Score) হল একটি পদ্ধতি যা প্রোটিনের গুণগত মান নির্ণয় করে। এটি বিশেষ করে প্রোটিনের অ্যামিনো অ্যাসিড প্রোফাইল বিশ্লেষণ করে এবং রেফারেন্স প্রোটিনের সাথে তুলনা করে।
রাসায়নিক সাফল্যাঙ্ক নির্ণয়ের পদ্ধতি:
১. অ্যামিনো অ্যাসিড প্রোফাইল বিশ্লেষণ: প্রথমে, পরীক্ষাধীন প্রোটিন এবং রেফারেন্স প্রোটিনের অ্যামিনো অ্যাসিড প্রোফাইল নির্ধারণ করতে হয়। সাধারণত ডিম বা দুধের প্রোটিনকে রেফারেন্স প্রোটিন হিসেবে ব্যবহার করা হয় কারণ এতে সব অপরিহার্য অ্যামিনো অ্যাসিড আদর্শ পরিমাণে থাকে।
২. প্রতিটি অপরিহার্য অ্যামিনো অ্যাসিডের তুলনা: প্রতিটি অপরিহার্য অ্যামিনো অ্যাসিডের কন্টেন্ট নির্ধারণ করা হয় (mg/g প্রোটিন হিসাবে) এবং তা রেফারেন্স প্রোটিনের সাথে তুলনা করা হয়।
৩. রাসায়নিক সাফল্যাঙ্ক নির্ণয়: প্রতিটি অপরিহার্য অ্যামিনো অ্যাসিডের তুলনা থেকে রাসায়নিক সাফল্যাঙ্ক নির্ধারণ করা হয়।
রাসায়নিক সাফল্যাঙ্কের সমীকরণ:
সাধারণত, প্রোটিনের রাসায়নিক সাফল্যাঙ্ক নির্ধারণের জন্য নিম্নলিখিত সমীকরণটি ব্যবহৃত হয়:
উদাহরণ:
ধরা যাক, আমরা পরীক্ষিত প্রোটিন এবং রেফারেন্স প্রোটিনের একটি নির্দিষ্ট অপরিহার্য অ্যামিনো অ্যাসিড, যেমন লাইসিনের (Lysine), তুলনা করছি।
সমাধান:
পরীক্ষিত প্রোটিনে প্রতি ১০০ গ্রামে লাইসিনের পরিমাণ: ৪ গ্রাম রেফারেন্স প্রোটিনে প্রতি ১০০ গ্রামে লাইসিনের পরিমাণ: ৫ গ্রাম
তাহলে রাসায়নিক সাফল্যাঙ্ক (Chemical Score) নির্ণয়ের সমীকরণটি হবে:
অর্থাৎ, এই ক্ষেত্রে পরীক্ষিত প্রোটিনের রাসায়নিক সাফল্যাঙ্ক হল ৮০%।
৭. রেফারেন্স প্রোটিন (Reference Protein):
রেফারেন্স প্রোটিন হলো একটি আদর্শ প্রোটিন যা অন্য প্রোটিনের গুণগত মান নির্ধারণের জন্য মানদণ্ড হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সাধারণত রেফারেন্স প্রোটিন হিসেবে ডিমের প্রোটিন বা দুধের প্রোটিন ব্যবহার করা হয় কারণ এতে সব অপরিহার্য অ্যামিনো অ্যাসিড আদর্শ অনুপাতে থাকে এবং সহজেই হজম হয়।
রেফারেন্স প্রোটিনের বৈশিষ্ট্য:
- সম্পূর্ণ প্রোটিন: রেফারেন্স প্রোটিনে সব অপরিহার্য অ্যামিনো অ্যাসিড পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকে।
- উচ্চ হজমযোগ্যতা: রেফারেন্স প্রোটিন সহজে হজম হয় এবং শরীরে শোষিত হয়।
- উচ্চ বায়োলজিকাল মূল্য: এর বায়োলজিকাল মূল্য (BV) এবং নিট প্রোটিনের সদ্ব্যবহার (NPU) উচ্চ হয়।
- মানদণ্ড: অন্যান্য প্রোটিনের গুণগত মান এবং কার্যক্ষমতা নির্ধারণের জন্য এটি মানদণ্ড হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
উদাহরণ:
ডিমের প্রোটিন:
ডিমের প্রোটিনকে সাধারণত রেফারেন্স প্রোটিন হিসেবে ব্যবহার করা হয় কারণ এতে সব অপরিহার্য অ্যামিনো অ্যাসিড সঠিক অনুপাতে থাকে এবং এটি সহজে হজম হয়।
দুধের প্রোটিন:
দুধের প্রোটিনও একটি আদর্শ রেফারেন্স প্রোটিন হিসেবে ব্যবহৃত হয় কারণ এতে উচ্চ মানের প্রোটিন এবং অপরিহার্য অ্যামিনো অ্যাসিড থাকে।
রেফারেন্স প্রোটিনের ব্যবহার:
- রাসায়নিক সাফল্যাঙ্ক নির্ধারণে: রাসায়নিক সাফল্যাঙ্ক (Chemical Score) নির্ধারণের সময় রেফারেন্স প্রোটিনের অ্যামিনো অ্যাসিড প্রোফাইলের সাথে পরীক্ষাধীন প্রোটিনের অ্যামিনো অ্যাসিড প্রোফাইল তুলনা করা হয়।
রাসায়নিক সাফল্যাঙ্ক নির্ধারণের পদ্ধতি:
অ্যামিনো অ্যাসিডের পরিমাণ নির্ধারণ:
- রেফারেন্স প্রোটিনের নির্দিষ্ট অ্যামিনো অ্যাসিডের পরিমাণ ।
- পরীক্ষিত প্রোটিনের নির্দিষ্ট অ্যামিনো অ্যাসিডের পরিমাণ ।
প্রত্যেক অপরিহার্য অ্যামিনো অ্যাসিডের রাসায়নিক সাফল্যাঙ্ক নির্ণয়:
ন্যূনতম রাসায়নিক সাফল্যাঙ্ক নির্ধারণ:
- সকল অপরিহার্য অ্যামিনো অ্যাসিডের রাসায়নিক সাফল্যাঙ্ক নির্ণয়ের পরে, যেটির মান সবচেয়ে কম, সেটিকে প্রোটিনের রাসায়নিক সাফল্যাঙ্ক হিসেবে গণ্য করা হয়। কারণ এটি প্রোটিনের সীমাবদ্ধ অ্যামিনো অ্যাসিড নির্দেশ করে।
উদাহরণ:
ধরা যাক, রেফারেন্স প্রোটিনে লাইসিন (Lysine) এর পরিমাণ ৫ গ্রাম/১০০ গ্রাম প্রোটিন এবং পরীক্ষিত প্রোটিনে লাইসিনের পরিমাণ ৪ গ্রাম/১০০ গ্রাম প্রোটিন।
সমাধান:
এভাবে অন্যান্য অপরিহার্য অ্যামিনো অ্যাসিডের রাসায়নিক সাফল্যাঙ্ক নির্ণয় করা হবে এবং সর্বনিম্ন মানটিকে প্রোটিনের রাসায়নিক সাফল্যাঙ্ক হিসেবে গণ্য করা হবে।
- প্রোটিন কার্যক্ষমতা নির্ধারণে: প্রোটিনের কার্যক্ষমতা এবং শরীরে প্রোটিনের ব্যবহারযোগ্যতা নির্ধারণের জন্য রেফারেন্স প্রোটিন ব্যবহৃত হয়।
- খাদ্য এবং পুষ্টি পরিকল্পনায়: খাদ্য এবং পুষ্টি পরিকল্পনার ক্ষেত্রে রেফারেন্স প্রোটিন মানদণ্ড হিসেবে ব্যবহৃত হয় যাতে প্রোটিনের গুণগত মান এবং কার্যক্ষমতা নির্ধারণ করা যায়।