বহুযৌগ শর্করা বা পলিস্যাকারাইড (Polysaccharides):
বহুযৌগ শর্করা (Polysaccharides) হল এক ধরনের জটিল শর্করা যা অনেকগুলো মনোস্যাকারাইড ইউনিট একত্রিত হয়ে তৈরি হয়। এই শর্করাগুলি প্রধানত উদ্ভিদ ও প্রাণীর মধ্যে পাওয়া যায় এবং বিভিন্ন বায়োলজিক্যাল ক্রিয়াকলাপে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রধান পলিস্যাকারাইডগুলি হলো:
- স্টার্চ (Starch): উদ্ভিদের শক্তি সংরক্ষণের মাধ্যম, যা শস্য ও কন্দে পাওয়া যায়।
- গ্লাইকোজেন (Glycogen): প্রাণীদের শক্তি সংরক্ষণের মাধ্যম, যা যকৃত এবং পেশীতে সংরক্ষিত হয়।
- সেলুলোজ (Cellulose): উদ্ভিদের কোষ প্রাচীরের উপাদান, যা মানুষের হজম প্রক্রিয়ায় অবশোষিত হয় না তবে আঁশ হিসেবে কাজ করে।
সমরূপ বহুশর্করা বা হোমোগ্লাইক্যান বা হোমোপলিস্যাকারাইড (Homopolysaccharides): পলিস্যাকারাইডের একটি শ্রেণী, যা একই ধরনের মনোস্যাকারাইড ইউনিট দ্বারা গঠিত। সমরূপ বহুশর্করার কিছু সাধারণ উদাহরণ হল সেলুলোজ, স্টার্চ, এবং গ্লাইকোজেন, যেগুলি সকলেই গ্লুকোজ মনোস্যাকারাইড দ্বারা গঠিত।
উদাহরণ ও তাদের রাসায়নিক সংকেত:
সেলুলোজ (Cellulose)
- সেলুলোজ প্রধানত উদ্ভিদের কোষ প্রাচীরে পাওয়া যায়।
- এটি β-ডি-গ্লুকোজ দ্বারা গঠিত এবং β(1→4) গ্লাইকোসিডিক বন্ধন দ্বারা সংযুক্ত।
- রাসায়নিক সংকেত: , যেখানে n হল গ্লুকোজ ইউনিটের সংখ্যা।
স্টার্চ (Starch)
- স্টার্চ উদ্ভিদে শক্তি সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হয়।
- এটি α-ডি-গ্লুকোজ দ্বারা গঠিত এবং দুটি প্রধান উপাদান আছে: অ্যামাইলোজ এবং অ্যামাইলোপেকটিন।
- অ্যামাইলোজ: α(1→4) গ্লাইকোসিডিক বন্ধন।
- অ্যামাইলোপেকটিন: α(1→4) এবং α(1→6) গ্লাইকোসিডিক বন্ধন।
- রাসায়নিক সংকেত:
গ্লাইকোজেন (Glycogen)
- গ্লাইকোজেন প্রাণীদের মধ্যে প্রধান শক্তি সংরক্ষণের মাধ্যম।
- এটি α-ডি-গ্লুকোজ দ্বারা গঠিত এবং α(1→4) এবং α(1→6) গ্লাইকোসিডিক বন্ধন দ্বারা সংযুক্ত।
- রাসায়নিক সংকেত:
বিসমরূপ বহুশর্করা বা হেটেরোগ্লাইক্যান বা হেটেরোপলিস্যাকারাইড (Heteropolysaccharides):
পলিস্যাকারাইডের একটি শ্রেণী, যা দুটি বা ততোধিক ভিন্ন ধরনের মনোস্যাকারাইড ইউনিট দ্বারা গঠিত। এই ধরনের পলিস্যাকারাইড বিভিন্ন জৈবিক ভূমিকা পালন করে, যেমন কোষের গঠন, সুরক্ষা, সঙ্কেত প্রেরণ এবং অন্যান্য বিভিন্ন কাজ।
উদাহরণ ও তাদের রাসায়নিক সংকেত:
হেমিসেলুলোজ (Hemicellulose)
- উদ্ভিদের কোষ প্রাচীরে সেলুলোজের সাথে মিশ্রিত হয়ে থাকে।
- এটি বিভিন্ন ধরনের শর্করা যেমন গ্লুকোজ, মানোজ, গ্যালাকটোজ, জাইলোজ এবং আরো অনেকগুলো দ্বারা গঠিত।
- রাসায়নিক সংকেত নির্দিষ্ট নয় কারণ এটি বিভিন্ন মনোস্যাকারাইড দ্বারা গঠিত।
পেকটিন (Pectin)
- উদ্ভিদের কোষ প্রাচীরের মধ্যে উপস্থিত থাকে এবং কোষের মধ্যে আঠালো পদার্থ হিসেবে কাজ করে।
- এটি মূলত গ্যালাকটিউরোনিক অ্যাসিড এবং র্যামনোস মনোস্যাকারাইড দ্বারা গঠিত।
- রাসায়নিক সংকেত নির্দিষ্ট নয় কারণ এটি বিভিন্ন মনোস্যাকারাইড দ্বারা গঠিত।
গ্লাইকোসামিনোগ্লাইকান (Glycosaminoglycan)
- প্রাণীদের জৈবিক টিস্যুর মধ্যে পাওয়া যায় এবং এটি বিশেষত সংযোগকারী টিস্যুর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ।
- এটি বিভিন্ন মনোস্যাকারাইড যেমন গ্লুকুরোনিক অ্যাসিড এবং এন-অ্যাসিটাইলগ্লুকোসামিন দ্বারা গঠিত।
- উদাহরণ: হায়ালুরোনান, কন্ড্রয়টিন সালফেট
- রাসায়নিক সংকেত নির্দিষ্ট নয় কারণ এটি বিভিন্ন মনোস্যাকারাইড দ্বারা গঠিত।
রাসায়নিক গঠন:
হেমিসেলুলোজের গঠন:
গ্লুকোজ-(1→4)-মানোজ-(1→4)-জাইলোজ-(1→4)-গ্যালাকটোজ-...
এটি একটি উদাহরণ মাত্র, কারণ হেমিসেলুলোজের গঠন বিভিন্ন হতে পারে।
পেকটিনের গঠন:
গ্যালাকটিউরোনিক অ্যাসিড-(1→4)-র্যামনোস-(1→4)-গ্যালাকটিউরোনিক অ্যাসিড-...
গ্লাইকোসামিনোগ্লাইকানের গঠন:
গ্লুকুরোনিক অ্যাসিড-(1→3)-এন-অ্যাসিটাইলগ্লুকোসামিন-(1→4)-গ্লুকুরোনিক অ্যাসিড-..
পাচ্যতা অনুসারে বহুযৌগ শর্করার শ্রেণীবিভাগ:
A. পাচ্য বহুযৌগ শর্করা (Digestible Polysaccharides)
B. অপাচ্য বহুযৌগ শর্করা (Indigestible Polysaccharides)
A. পাচ্য বহুযৌগ শর্করা (Digestible Polysaccharides):
পাচ্য বহুযৌগ শর্করা (Digestible Polysaccharides) হল এক ধরনের বহুযৌগ শর্করা যা হজমশীল এবং আমাদের শরীরের দ্বারা শক্তি উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হয়। এই শর্করাগুলি সহজেই হজম হয়ে গ্লুকোজে রূপান্তরিত হয়, যা আমাদের শরীরের প্রাথমিক শক্তি উৎস।
পাচ্য বহুযৌগ শর্করার ধরন:
স্টার্চ (Starch):
- প্রধান পাচ্য বহুযৌগ শর্করা।
- উদ্ভিদের মধ্যে শক্তি সংরক্ষণের প্রধান মাধ্যম।
- খাদ্য হিসেবে যেমন চাল, গম, আলু ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়।
গ্লাইকোজেন (Glycogen):
- প্রাণী ও মানুষের মধ্যে পাওয়া যায়।
- লিভার ও পেশীতে শক্তির সংরক্ষণ হিসেবে কাজ করে।
পাচ্য বহুযৌগ শর্করার গঠন ও বৈশিষ্ট্য:
গঠন: স্টার্চ এবং গ্লাইকোজেন গ্লুকোজের একাধিক ইউনিট দ্বারা তৈরি, যা গ্লাইকোসিডিক বন্ধনের মাধ্যমে যুক্ত থাকে।
- স্টার্চ: দুটি প্রধান উপাদান আছে, অ্যামাইলোজ (Amylose) এবং অ্যামাইলোপেকটিন (Amylopectin)।
- অ্যামাইলোজ: সরল শৃঙ্খলাকার।
- অ্যামাইলোপেকটিন: শাখাবিশিষ্ট শৃঙ্খলাকার।
- গ্লাইকোজেন: অধিক শাখাবিশিষ্ট শৃঙ্খলাকার, যা তাড়াতাড়ি গ্লুকোজ মুক্ত করতে সহায়ক।
- স্টার্চ: দুটি প্রধান উপাদান আছে, অ্যামাইলোজ (Amylose) এবং অ্যামাইলোপেকটিন (Amylopectin)।
দ্রাব্যতা:
- স্টার্চ সাধারণত ঠান্ডা জলে অদ্রবণীয়, কিন্তু গরম জলে দ্রবণীয় হয়ে যায়।
- গ্লাইকোজেন গরম এবং ঠান্ডা উভয় অবস্থায় পানিতে দ্রবণীয়।
পাচ্য বহুযৌগ শর্করার হজম প্রক্রিয়া:
মুখ:
- পটিরিয়াল অ্যামাইলেজ (Salivary Amylase) স্টার্চকে ছোট ছোট ডেক্সট্রিন এবং মাল্টোজে ভাঙে।
পাকস্থলী:
- পাকস্থলীর অ্যাসিড হজম এনজাইমগুলোকে সক্রিয় করে এবং পটিরিয়াল অ্যামাইলেজকে নিষ্ক্রিয় করে।
ক্ষুদ্রান্ত্র:
- প্যানক্রিয়াটিক অ্যামাইলেজ (Pancreatic Amylase) স্টার্চকে আরও ভাঙে।
- ম্যাল্টেজ, সুক্রেজ এবং ল্যাক্টেজ এনজাইমগুলি ডাইস্যাকারাইড এবং ওলিগোস্যাকারাইডগুলিকে মনোস্যাকারাইডে ভাঙে।
শোষণ:
- মনোস্যাকারাইডগুলি অন্ত্রের দেওয়াল দিয়ে রক্তপ্রবাহে শোষিত হয় এবং শরীরের বিভিন্ন কোষে পৌঁছে যায়, যেখানে এরা শক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
পাচ্য বহুযৌগ শর্করার ভূমিকা:
- শক্তি উৎস: এই শর্করাগুলি দ্রুত গ্লুকোজে পরিণত হয়ে আমাদের শরীরে শক্তি সরবরাহ করে।
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি: হজম প্রক্রিয়ার উন্নতিতে সহায়তা করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
- পুষ্টি সরবরাহ: অন্যান্য পুষ্টি উপাদান যেমন প্রোটিন এবং ফ্যাটের সাথে সমন্বিত হয়ে শরীরের বিভিন্ন কার্যক্রমে সহায়ক হয়।
অপাচ্য বহুযৌগ শর্করা (Indigestible Polysaccharides), যা সাধারণত ডায়েটারি ফাইবার (Dietary Fiber) নামে পরিচিত, হল এমন ধরনের শর্করা যা মানুষের হজম প্রক্রিয়ায় ভাঙতে পারে না। এই শর্করাগুলি সাধারণত উদ্ভিজ্জ খাদ্যে পাওয়া যায় এবং আমাদের পরিপাকতন্ত্রের বিভিন্ন কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
অপাচ্য বহুযৌগ শর্করার ধরন:
সেলুলোজ (Cellulose):
- উদ্ভিদের কোষ প্রাচীরের প্রধান উপাদান।
- খাদ্য হিসেবে যেমন শাকসবজি, ফল, এবং পুরো শস্যে পাওয়া যায়।
হেমিসেলুলোজ (Hemicellulose):
- সেলুলোজের সাথে উদ্ভিদের কোষ প্রাচীরে পাওয়া যায়।
- পুরো শস্য, শাকসবজি এবং ফলের মধ্যে পাওয়া যায়।
পেক্টিন (Pectin):
- ফল এবং কিছু শাকসবজিতে পাওয়া যায়।
- জাম, জেলি ইত্যাদির প্রস্তুতিতে ব্যবহৃত হয়।
লিগনিন (Lignin):
- উদ্ভিদের কোষ প্রাচীরের একটি কাঠামোগত উপাদান।
- সম্পূর্ণ শস্য, বীজ এবং সবজিতে পাওয়া যায়।
বিটা-গ্লুকান (Beta-Glucan):
- ওট এবং বার্লির মধ্যে পাওয়া যায়।
- পুষ্টির চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক।
অপাচ্য বহুযৌগ শর্করার গঠন ও বৈশিষ্ট্য:
- গঠন: অপাচ্য বহুযৌগ শর্করা বিভিন্ন মনোস্যাকারাইড ইউনিট দ্বারা গঠিত, যা মানুষের হজম এনজাইম দ্বারা ভাঙতে পারে না।
- দ্রাব্যতা: কিছু অপাচ্য বহুযৌগ শর্করা পানিতে দ্রবণীয় (যেমন পেক্টিন, বিটা-গ্লুকান), আর কিছু পানিতে অদ্রবণীয় (যেমন সেলুলোজ, লিগনিন)।
অপাচ্য বহুযৌগ শর্করার ভূমিকা:
হজম প্রক্রিয়ার উন্নতি:
- অপাচ্য বহুযৌগ শর্করা অন্ত্রে পানি শোষণ করে এবং মলকে নরম করে, যা কোষ্ঠকাঠিন্য রোধে সহায়ক।
রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ:
- দ্রবণীয় ফাইবার (যেমন পেক্টিন) খাবারের শর্করা হজম ও শোষণ প্রক্রিয়ার গতি কমিয়ে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।
কোলেস্টেরল মাত্রা হ্রাস:
- কিছু অপাচ্য বহুযৌগ শর্করা (যেমন বিটা-গ্লুকান) কোলেস্টেরল শোষণে বাধা প্রদান করে এবং কোলেস্টেরলের মাত্রা হ্রাস করে।
ওজন নিয়ন্ত্রণ:
- ফাইবারযুক্ত খাবার খেলে পেট ভরা অনুভূতি দেয়, যা অতিরিক্ত খাওয়ার প্রবণতা কমায় এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হয়।
স্বাস্থ্যকর অন্ত্র ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধিতে সহায়ক:
- অপাচ্য বহুযৌগ শর্করা প্রিবায়োটিক হিসাবে কাজ করে, যা অন্ত্রের স্বাস্থ্যকর ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধিতে সহায়ক।
খাদ্য উৎস:
- দ্রবণীয় ফাইবার: ওট, বার্লি, ফল (আপেল, সাইট্রাস ফল), শাকসবজি।
- অদ্রবণীয় ফাইবার: গোটা শস্য, গমের ভূষি, বাদাম, সবুজ শাকসবজি।